ঝিনাইদহ জেলা তথা বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় পুরাকীর্তির মধ্যে শৈলকুপা শাহী মসজিদ উল্লেখযোগ্য। কুমার নদের উত্তর তীরে শৈলকুপা উপজেলার পৌর শহরের দরগাপাড়ায় এ মসজিদ অবস্থিত। কালের প্রবাহ ভেদ করে প্রায় ৫০০ বছরের পুরাতন এ মসজিদ প্রাচীন ঐহিত্য ও মধ্যযুগীয় মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের জলন্ত সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। দূর-দূরান্ত থেকে যারা মসজিদটি প্রতিদিন দেখতে আসেন, সবার কাছেই মসজিদটি যেমন দর্শনীয়, তেমনি আকর্ষণীয়।
এ মসজিদের স্থাপত্যশৈলী চমৎকার ও অনুপম। ইহা মধ্যযুগীয় বাংলার একটি আকর্ষণীয় স্থাপত্যকীর্তি। লাল রংয়ের ছোট ছোট পাতলা ইটের তৈরী এ মসজিদে প্লাস্টারবিহীন ইটের গাঁথুনি দেখা যেত, যা প্লাস্টারের সময় ঢাকা পড়ে। চুন-সুরকি দিয়ে ছোট পাতলা ইটের গাঁথুনি চমৎকার। মসজিদের প্রতি দেওয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৫ ফুট। এ মসজিদের চার কোণায় ৪টি গোলাকার টাওয়ার আছে। নিচ থেকে উপর দিকে ক্রমশ ঢালুভাবে নির্মিত টাওয়ার এগুলো। স্থাপত্যকালে এ মসজিদে কোন মিনার ছিলনা। ১৯৪২ সালে সর্বপ্রথম মসজিদ সংস্কারকালে মিনার নির্মাণের উদ্দেশ্যে অষ্টকোণাকৃতির দু’টি ইটের স্তম্ভ তৈরী করা হয়। কিন্তু মিনার নির্মাণ অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
মসজিদটির বর্হিদিকের পরিমাণ ৪৪×৩৩ ফুট, ভিতরে নামাজ কক্ষের পরিমাণ ৩৩×২২ ফুট। পূর্বদিকের সম্মুখভাগের ঠিক মাঝখানে খিলানযুক্ত প্রধান প্রবেশদ্বার। দ্বিকেন্দ্রিক সুচাঁলু খিলানের সাহায্যে এ প্রবেশদ্বার নির্মিত। ভূমি থেকে মসজিদের কার্নিশের উচ্চতা ১৮ ফুট। কার্নিশের নিচ দিয়ে আনুভূমিক কয়েকটি মোল্ডিং ব্যান্ড দিয়ে বর্হিদেয়াল অলংকৃত। মসজিদের ছাদ কিছুটা বাঁকা করে নির্মিত। কার্নিশটি বক্র ছাদের মধ্যস্থল থেকে ক্রমশ দু’দিকে ঢালু হয়ে কোণায় টাওয়ারগুলোতে মিশেছে। কার্নিশের নিচ দিকে ইমারতের চারদিকের বহিগাঁত্র এবং পার্শ্ব দেয়ালের খিলানগুলোর উপরের অংশ অলংকৃত পোড়ামাটির ফলক দ্বারা আবৃত। মসজিদের কেবলা দেয়ালে রয়েছে ৩টি অবতল মিহরাব। ৫.৫ পুরু দেয়ালের মধ্যে দ্বিকেন্দ্রিক সুঁচালু খিলানের সাহায়্যে কুলুঙ্গি তৈরি করে মিহরাবগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মাঝখানের মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় সেটা পশ্চিম দিকে দেয়ালের কিছুটা বাইরে প্রসারিত। পশ্চিম দেয়ালে আয়তকার ফ্রেমের মধ্যে তৈরি মিহরাবগুলো অবতল দিকে ফুল-পাতা ও জ্যামিতিক নকশা দ্বারা অলংকৃত এবং ফ্রেমের উপরে কলসাকার ফুলের টব ও পদ্ম স্তপ ফুলের অলংকরণ রয়েছে। মাঝখানের মিহরাবটির প্রশস্ত ২'-৬'' ও উচ্চতা ৬ ফুট এবং প্রাচীর গাঁত্রে গভীরতা ২'-৬''। অপর দু’টি মিহরাব অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির। প্রতিটি প্রশস্ত ২ ফুট, উচ্চতা ৪ ফুট এবং গভীরতা ১.৫ ফুট।
নামাজ কক্ষটি দু’টি ‘আইল’ এবং তিনটি ‘বে’ বিভক্ত। কালোপাথরের তৈরি দু’টি অষ্টকোণাকার স্তম্ভের উপর খিলানের সাহায্যে ৬টি গম্বুজ বসিয়ে নামাজ কক্ষটি আচ্ছাদিত। মেঝে থেকে গম্বুজের উচ্চতা ২৬ ফুট ও ব্যাসার্ধ ৩ ফুট এবং মুখের ব্যাসার্ধ ১৩ ফুট। মসজিদ কক্ষের অভ্যন্তরে প্রথিত প্রস্তর খন্ডের উপর গম্বুজের খিলানযুক্ত ছয়টি পিলপা সংস্থাপিত। ভিতর থেকে গম্বুজগুলো বেশ উঁচু মনে হলেও বাইরে থেকে সেগুলো আশানুরূপ দৃষ্টি গোচর হয়না। এ মসজিদে কোন ড্রাম ব্যবহার করা হয়নি। চারকোণে চারটি লম্বাকৃতি বুরুজ মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। মেঝে সংলগ্ন উত্তর প্রাচীরে দু’টি ও দক্ষিণ প্রাচীরে দু’টি, মোট ৪টি জানালা জাতীয় গহবর আছে। ১৯৮২ সালে এ সব গহ্বরে প্রতিবন্ধক সরূপ লোহার রড লাগানো হয়। এছাড়া মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ছোট আকৃতির ৪টি গহবর দেখা যায়। সংস্কারের পূর্বে কার্নিশ বক্রাকার ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এখন সমান্তরাল করা হয়েছে। সম্মুখভাগের মধ্যবর্তী স্থানটি উঁচু করে নির্মিত হয়েছে ও ইটের নকশাকৃত। কার্নিশ চওড়া ২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং মেঝে থেকে ধনুকচক্রে কার্নিশের দূরত্ব ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি।জুম্মার দিনে মুসল্লিদের নামাজ আদায় স্থান সংকুলান হয় না বিধায় মসজিদ সংলগ্ন পূর্বদিকে নতুনভাবে একতলা ভবন তৈরি করে নামাজগৃহকে বর্ধিত করা হয় ১৯৯৫ সালে। মসজিদের ৫০ ফুট উত্তরে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা একটি পুকুর রয়েছে। যার দৈঘ্য ২০০ ফুট, প্রস্থ ১৫০ ফুট ও গভিরতা ৩০ ফুট। মসজিদের ঠিক পূর্ব দিকে পীরের মাজার সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বে ২০০৫ সালে ওজুখানা নির্মিত হয়। এখানে ৩২ জন মুসল্লি একসাথে ওজু করতে পারে।
শৈলকুপা শাহী মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে অনেক দ্বিধা-বিভক্তি রয়েছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত হলো, শৈলকুপার শাহী মসজিদ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর পুত্র নাসির শাহর ওরফে নসরত শাহর রাজত্বকালে তাঁরই নির্দেশ মোতাবেক উজির শাহ আলীর পরিচালনায় নির্মিত।নসরত শাহ মসজিদ নির্মাণে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে বাংলাদেশে অনেক মসজিদ নির্মিত হয়। সুলতান নাসির উদ্দীন ১৫১৯ সাল হতে ১৫৩২ সাল পর্যন্ত বাংলার সুলতান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরই রাজত্বকালে মোঘল কেশরী বাবর ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে দিল্লীশ্বর ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এ মসজিদ নির্মিত বলে অনুমিত হয়। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, ১৫২৩-১৫২৪ সালের মধ্যে মসজিদটি নির্মিত। সুলতান নসরত শাহর রাজত্বকালে পীর আরব শাহ রব্বানী ইন্তেকাল করেন এবং তাঁকে এ মসজিদের পূর্ব পার্শ্বে সমাহিত করা হয়। উজির শাহ আলী পীরের মাজার পাঁকা করেন। উজির শাহ আলীও নাসির শাহর রাজত্বকালে শেষভাগে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁকেও পীরের মাজারের পশ্চিম পার্শ্চে সমাহিত করা হয়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস